অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে কি না— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা আদালত দ্বারা অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। এই রায়ের ভিত্তিতে পঞ্চদশ সংশোধনীও করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসার সম্ভাবনা আমি দেখি না।’
রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে শনিবার পদোন্নতিপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজদের নিয়ে আয়োজিত দশম ওরিয়েন্টেশন কোর্সের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী এ কথা বলেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো, তবে ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তব্যে সে সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। জাতীয় নির্বাচন কার অধীনে হবে, এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সেই সরকারের স্থায়িত্বকালেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনকে যেসব সহযোগিতা লাগে এবং যেসব সরকারি বিভাগগুলো তাদের আওতায় থাকে, সেইগুলো নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনায় চলবে। আর সরকার ডে টু ডে রুটিন কাজ করবে। সেই আদলেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীদের বাগবিতণ্ডার ঘটনা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা বলছেন বারবার ঘটছে। আমি বলব, এখন যেমন বিষয়টি মিডিয়ার নজরে আসছে, আগে কিন্তু এমনটি ছিল না। এ রকম ঘটনা বারে ঘটেই থাকে। মাঝে মাঝে এমন হয়, বারের যারা সিনিয়র আছেন, তারাই এটা শেষ করে দেন। কখনও কখনও এটা বিজ্ঞ জেলা জজ সাহেব শেষ করে দেন। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, একটি ঘটনা তার অধিক্ষেত্রের অতিরিক্ত ঘটে গেছে। এই সমস্যা সমাধান করার জন্য আমরা সচেষ্ট।
এর আগে,পদোন্নতিপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজদের নিয়ে আয়োজিত দশম ওরিয়েন্টেশন কোর্সের বক্তব্যকালে মন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও গতিশীল বিচার বিভাগের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত এবং অসহায় মানুষগুলো স্বল্প খরচে দ্রুত ন্যায়বিচার পাবেন। বস্তুত ন্যায়বিচার খাদ্য ও বস্ত্রের মতোই জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য উপাদান। কেননা খাদ্য ছাড়া যেমন জীবন বেঁচে থাকতে পারেনা, বস্ত্র ছাড়া যেমন মানুষ জনসম্মুখে বের হতে পারে না, তেমনি ন্যায়বিচার ছাড়া মানুষ সমাজে শান্তিতে বসবাস করতে পারেনা। ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতিতে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, সামাজিক অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। আর সমাজ নিয়েই যেহেতু রাষ্ট্র, তাই অস্থিতিশীল সমাজ মানেই অস্থিতিশীল রাষ্ট্র। এরূপ রাষ্ট্রের সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রসমূহ বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক স্থাপন করতে অনীহা দেখায়, তারা বিনিয়োগ করতে ভয় পায়। পরিণতিতে ওই রাষ্ট্র বিশ্ব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, উন্নয়ন বিঘ্নিত হয়।
তাই জাতির পিতা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সবসময় তৎপর থেকেছেন। এমনকি পাকিস্তানি শাসন আমলে তিনি যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সুযোগের সমতা নিশ্চিতকরণের বিষয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে কথা বলেছেন।
মন্ত্রী বলেন, কোনো দেশে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে অপরাধকর্মে জড়িত প্রত্যেক অপরাধীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক এবং এসব বিচার যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার শুরু থেকেই বিচার বিভাগকে সবধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ও সুপ্রীম কোর্ট দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে দেশের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত মামলাজট কমানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। যার সুফল ইতোমধ্যেই জনগণ পেতে শুরু করেছে। প্রায়শই খবর পাওয়া যাচ্ছে, দেশের অনেক আদালতেই এখন, একক সময়ে মামলা হওয়ার সংখ্যার চেয়ে মামলা নিষ্পত্তির হার বেশি হচ্ছে। এটি আমাদেরকে আশান্বিত করছে।
তিনি বিশ্বাস করেন, সরকার ও সুপ্রীম কোর্টের বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি বিজ্ঞ বিচারকদের উদ্ভাবনীমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ, বিচারিক কর্মঘন্টার সঠিক প্রয়োগ, কার্যকর মামলা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, দক্ষ আদালত ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি তাদের সুদক্ষ নেতৃত্বের কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগ মামলার বোঝা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে। বিচার প্রক্রিয়ায় অংশীজনদের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেও মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এসব ক্ষেত্রে সব বিচারক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, এখানে একটি মামলার অনেকগুলো পক্ষ তৈরি হয়ে যায়। কোন পক্ষ চায়, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। কোন পক্ষ চায়, মামলা নিষ্পত্তির সময় প্রলম্বিত হোক। কেউ কেউ হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করে আদালতের কালক্ষেপন করে থাকেন। এসব বিষয়কে মাথায় নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। দ্রুত গতিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আবার এক্ষেত্রে ভুলে গেলে চলবে না “Justice Hurried is Justice Buried”; বদান্যতা, মহানুভবতা, কৃতজ্ঞতা, বন্ধুত্ব ও করুণা থেকে ন্যায়বিচার আলাদা। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মর্মমূলে রয়েছে নিরপেক্ষতার ধারণা।
আনিসুল হক বলেন, আমরা রাষ্ট্রের যে, যে দায়িত্বই পালন করি না কেন, প্রত্যেকের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সব সময় সাধারণ জনগণ বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের নিকট দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্মরণ রাখা উচিত। কেননা লাখ লাখ শ্রমিক ও গার্মেন্টস কর্মীর গা ঘামানো পরিশ্রমের বিনিময়েই আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকা রপ্তানী আয় হয়, এক কোটির অধিক প্রবাসী কর্মীর রেমিটেন্স পাঠানোর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়ে, গ্রামের কৃষক ভাই-বোনদের রোদ-বৃষ্টিতে মাঠে নেমে ফসল ফলানোর ফলেই আমরা শহরে বসে তা খেতে পারি। আবার তাদের করের টাকায় আমাদের বেতন-ভাতা হয়। বাস্তবতা হলো সমাজে এসব মানুষই বেশি ভোগান্তির শিকার হন, শোষিত-বঞ্চিত হন। যদিও জাতির পিতা স্বয়ং কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করে গেছেন। তাই বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে যাতে আদালতের বারান্দায় বছরের পর বছর জুতার তলা ক্ষয় করতে না হয়, সে বিষয়ে বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। অধিকন্তু তারা যাতে সেবা নিতে এসে কোনভাবে অবজ্ঞা বা হয়রানির স্বীকার না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকা উচিত।
বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার সভাপতিত্ব অনুষ্ঠানে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সাওয়ার ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) শেখ আশফাকুর রহমান বক্তৃতা করেন।
Leave a Reply